যা হারিয়ে যায়
-থিওডোর ড্রেইসার
(অনুবাদে- বর্ণালী জানা সেন)
এককালে ছিল রীতিমতো বর্ধিষ্ণু গ্রাম। এখন অবস্থা পড়তির দিকে। লোকজনের সংখ্যা কমতে কমতে এখন হাতেগোনা। সবচেয়ে কাছের শহর এখান থেকে প্রায় তিন মাইল। একটা বাড়ি থেকে পরের বাড়িটাই কমসে কম এক মাইল। আর মাইলের পর মাইল জুড়ে শুধু গম, ভুট্টার ক্ষেত আর বাদা জমি। চাষের মরসুম শেষ হয়ে গেলে জমিতে লাগানো হয় টিমোথি আর ক্লোভার ঘাস। তা দিয়ে গরু…ঘোড়ার জাবনা হয়।
এই গ্রামেই তাদের আস্তানা। তাদের বাড়ি কিছুটা কাঠের আর কিছুটা ইটের গাঁথনি। বাড়ির পুরোনো কাঠের অংশটা তৈরি করেছিলেন হেনরির বাবা। পরে নতুন যে অংশটা যোগ হয়েছে তার অবস্থাও তথৈবচ। বৃষ্টি বাদলা, ঝড় আর বরফে প্রায় ভেঙে পড়ে আরকি। কার্নিস প্রায় ধসে গিয়েছে। এখানে ফাটল ওখানে ফাটল। ফাটল দিয়ে জল পড়ে…ঘরে ঠান্ডা বাতাস ঢোকে। চারপাশের এলম, বাটারনাটের গাছের ছায়ায় বাড়িটা প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে। বাইরে দেখে মনে হয় গা ছমছমে নিশুত পুরী। রোদ ঢোকেনা বাড়িতে। সবসময় একটা স্যাঁতস্যাঁতে ভাব। বাড়ির এই নতুন অংশটা তৈরি করেছে হেনরি। তখন তার সবে একুশ। সদ্য বিয়ে করেছে। তাও দেখতে দেখতে আটচল্লিশ বছর কেটে গেল। বাড়িটার মতো বাড়ির আসবাবগুলোও লড়ঝরে। কোন আদ্যিকালের স্মৃতি বুকে নিয়ে আজও রয়ে গেছে ওগুলো। চেরি কাটের প্যাঁচানো পা আর গম্বুজওলা আলমারি আছে একখানা। চারদিকে ছত্রি লাগানো খাটও রয়েছে। সে খাটও ভেঙে চূরে গেছে এখানে ওখানে। কোন মান্ধাতার আমল থেকে যে এটা রয়েছে কে জানে! চেরি কাঠের টেবিলও রয়েছে একটা। বেশ লম্বা। শক্তপোক্ত। কিন্তু রঙ টং সবে চটে গেছে। টেবিলের কাছে গেলেই একটা বোঁটকা গন্ধ নাকে আসে। মেঝেতে কার্পেট। ফীবি অ্যান যত্ন করে বানিয়েছিল ওটা। তার অবস্থা তো আরো করুণ। ছিঁড়ে খুড়ে একসা। ফীবি অ্যানের বানানো গোলাপী আর ছাই রঙা কার্পেটের এখন আর কোনো রঙ বোঝা যায় না। মারা যাওয়ার পনে…রো বছর আগে সে এটা বানিয়েছিল। কাঠের যে তাঁত যন্ত্রটা দিয়ে সে এটা বানিয়েছিল সেটা এখন পরিত্যক্ত অবস্থায়। ভাঙ্গা রকিং চেয়ার, ইস্ত্রি—সেগুলোও অযত্নে, অবহেলায় পড়ে রয়েছে ঘরের এককোণে। কোন আদ্যিকালের জিনিস এগুলো ভগবান জানেন। বাইরের দরজায় ফুল রাখার জন্য বানানো কাঠের বেঞ্চি, আরো সব ভাঙাচোরা জিনিস পত্র সব ডাঁই করে রাখা আছে পুব দিকের ঘরে। বাড়ির মূল অংশটার ওপর হেলে এসেছে এই ঘর। ভাঙাচোরা সব আসবাব, ছেঁড়া একটা কাপড়ের ঘোড়া, চেরি কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো ফাটা একটা আয়না, টুপি রাখার র্যাকক, পুরোনো একখানা সেলাই মেশিন এ যুগের পক্ষে বড্ড বেমানান। ওই যেবার আংটা থেকে আয়নাটা পড়ে ভেঙে গেল তার তিন তিনদিন পরেই তো তাদের ছোট ছেলেটা মারা গেল। তার ওই টুপি রাখার র্যারকে এক সময় চকচকে পোর্সিলিনের আংটা ছিল। সেসব আর নেই। পুরোনো দিনের স্মৃতি সব।
বাড়ির পুব দিকের বাগানে মোটা গুঁড়িওলা সব আপেল গাছ। সেসব গাছ আর ফল দেয় না। গোড়াতে উই ধরে একদম ফোঁপরা করে দিয়েছে। গাছের ডালে সবজে সাদা ছত্রাক। ভরা চাঁদের রাতে এই পোকায় কাটা, ছাতা ধরা গাছগুলোকে দেখে মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে যায়। ঘরের পাশে গোয়ালে আগে থাকত মুরগি, একটা কি দুটো ঘোড়া, গরু কয়েকটা শুয়োর। সে ঘরের ছাদেও ছত্রাকে ভর্তি। দেওয়ালের কালচে ছাই রঙের অবশিষ্ট আর কিছু নেই। ছত্রাক জমে জমে দেওয়ালগুলো একদম পিছল হয়ে গেছে। বাড়ির সামনের কাঠের বেড়াটার দশাও জরাজীর্ণ। টানলেই ক্যাঁচকোঁচ করে। বাড়ির চারপাশের বাঁশের বেড়াও ভেঙে পড়বে যে কোনো দিন। এ বাড়ির লোকগুলোর মতো বাড়ির জিনিসপত্র…আরো যা কিছু আছে সবেতেই জরা ধরেছে। বাড়ির বাসিন্দা বলতে তো মোটে দুজন হেনরি রেইফস্নেইডার আর তাঁর স্ত্রী ফীবি অ্যান।
বিয়ের পর এই এতকাল কেটে গেল এই বাড়িতে। তাও নয় নয় করে আটচল্লিশ বছর। আর হেনরির জম্ম কম্ম তো এই বাড়িতেই। তখন তার কতই বা বয়স। বাবা-মা বুড়ো হয়েছেন। ছেলেকে বললেন বিয়ে করতে। ছেলে তখন প্রথম প্রেমে পড়েছে। বাবা মার কথা শুনে সে বিয়ে করে বউ নিয়ে এল বাড়িতে। এতদিন বাবা-মায়ের সঙ্গেই দিন কেটেছে। তারপর বাড়িতে এল নতুন বউ। বিয়ের দশ বছর পর বাবা-মাও ছেড়ে চলে গেলেন চিরদিনের জন্য। পাঁচ ছেলে মেয়েকে নিয়ে তখন হেনরি আর ফীবির সংসার। বাচ্চারা তরতরিয়ে বাড়ছে। তখন থেকেই তাদের অবস্থা পড়ে এল। লোকে বলে তাঁদের নাকি সাত ছেলে মেয়ে হয়েছিল। তিন জন বাঁচেনি। আর যারা ছিল তারাও সব চলে গেল দূরে। এক মেয়ে চলে গেল কানসান। এক ছেলে গেল সিউক্স ফক্সে। তার আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। আরেক ছেলে সোজা গেল ওয়াশিংটনে। আরেক মেয়ে কাছাকাছিই থেকে। মাঝে মাত্র পাঁচটা গ্রাম। কিন্তু সে নিজের সংসার নিয়ে এতই ব্যস্ত বাবা-মায়ের খবর নেওয়ার সময়ই হয় না। ঘর সংসারের হাজারো ঝামেলা…নিজেদের ব্যস্ততা নিয়ে তারা এতই দিশেহারা বাবা-মায়ের কথা আর মনে পড়ে না।
হেনরি রেইফস্নেইডার আর ফীবি নিপাট ভালো মানুষ। দুজনে দুজনকে নিয়ে দিব্যি আছেন তাঁরা। পাথরের ওপর জমে থাকা শ্যাওলার মতোই একে ওপরকে জড়িয়ে বেঁচে আছেন। শত বাধা-বিপত্তিতেও তারা তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরেনি কোনো। বাইরের পৃথিবীতে কতকিছু ঘটে যায়। তাতে কিছু যায় আসে না তাঁদের। নিজেদের ভাঙাচোরা ঘরের কোণে নিজেদের নিয়েই দিন কেটে যায়। গম পাকলে তা কেটে ঝাড়াই করা… ভুট্টা বাদামী হয়ে এলে আবার তা বেছেবুছে রাখা… টিমোথি ঘাস বেশি লম্বা হয়ে গেলে কাটাকুটি করে খড়ের গোলা বানানো এসব কাজেই সাদাসিধে দুটো মানুষের দিন কেটে যায়। শীত এলে খেতের গম, ভুট্টা বেচার জন্য বাজারে নিয়ে যেতে হয়। তারপর থাকে কাঠ কাটা…ফায়ার প্লেসে আগুন দেওয়া, খাবার দাবার বানানো, ঘরের জিনিস পত্র একটু সারাই করা আর একটু এদিক ওদিক যাওয়া…এই নিয়েই তো তাদের জীবন। শীতে বরফ পড়ে, বর্ষা আসে… তারপর আসে রোদ ঝলমলে দিন…তাদের কাছে এসবের কোনো মানে নেই। তাদের জীবন বয়ে যায় একই খাতে। বাইরের জীবনের সবকিছু যেন কল্পনায় ভেসে আসা দৃশ্য… ওই দূর আকাশের মিটমিটে তারাটার মত…দেখা যায় কিন্তু ছোঁয়া যায় না…কিংবা দূরের খেত থেকে ভেসে আসা গরুর গলার ঘণ্টির মতোই ক্ষীণ।
হেনরি আর ফীবির ভালোবাসার অন্ত নেই। তাদের জীবনে ভালোবাসার মতো অন্য কিছু নেই। লতার মতো একে অপরকে জড়িয়েই কাটে তাদের দিন। হেনরির বয়স হয়েছে। ফীবি যখন মারা যায় তখনই হেনরির বয়স সত্তর। সারাক্ষণ খিট মিট করেই যাচ্ছেন। তার জলভরা ঘোলা চোখের দিকে তাকালে মায়া হয়। কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে এসেছে। যা পরেন ঢলঢল করে। কেমন একটা বেখাপ্পা লাগে তাঁকে। জামা হাতের কাছে ছেঁড়া, প্যান্টটা হাটুতে ফাটা। জীবনে কোনোদিন কাচা হয়েছে বলে তো মনে হয়না। ফীবি অ্যানের চেহারাও প্যাকাটির মত…কোনো ছিরি ছাঁদ নেই। একটা কালো জামা আর একটা কালো টুপি…এর চেয়ে ভালো পোশাক নেই তাঁর কাছে।
সময় বয়ে যায়। একে অন্যকে নিয়ে তাঁরা বাঁচেন। দেখাশোনার তো আর কেউ নেই। বয়সের সঙ্গে হাত পায়ের জোর কমে গেছে। এখন তার তেমন কাজও করে ঊঠতে পারে না । পাঁচটা শুয়োরের মধ্যে চারটেই বিক্রি করে দিতে হয়েছে। এখন রয়েছে মোটে একটা…গায়ে বেশ গত্তি আছে শুয়োরটার। কাটলে ভালোই মাংস হবে। যে ঘোড়াটাকে হেনরি রেখে দিয়েছে সেটাও একেবারে দুবলা পাতলা…কমজোরি। ভারো করে খেটে টেতেও পায় না বোধহয়। ওটাকেও জম্মে স্নান টান করানো হয়না । খাঁচায় আগে কত মুরগি ছিল। বেজি, শেয়াল এসে সব ধরে নিয়ে গেছে। আর অবশিষ্ট যেগুলো ছিল সেগুলোও যত্নের অভাবে রোগে ভুগে মরেছে। আগের সেই সাজানো গোছানো বাগান এখন শুকিয়ে গেছে। আগে বাড়ির জানালা…দরজার সামনেটা ফুলে ফুলে সেজে থাকত। সে সেই কবেকার কথা। একজন বাগান জুড়ে শুধু বুনো ঝোপঝাড়। কর দিতে দিতে নাজেহাল অবস্থা বাড়ির কর্তার। করের ভার চেপে থাকা এই ভাঙাচোরা বাড়ির একটা উইলও অবশ্য তৈরি করা হয়েছিল…চার ছেলেমেয়ের মধ্যে সমান ভাগ করে। ছেলে মেয়েরা কেউ অবশ্য এই ভাঙাচোরা বাড়ির ভাগ নিতে আসবে না। সেইজন্যই চার ভাগ করে এই উইল করা। এই বৃদ্ধ দম্পতি নিজেদের নিয়েই বেশ আছে। তবে হেনরির মাথার পোকাটা মাঝে মাঝে নড়ে ওঠে। ছোটখাটো সামান্য বিষয় নিয়ে বাড়ি তোলপাড় করে দেয়… ‘ ফীবি, আমার ভুট্টা কাটার ছুরিটা কোথায়? আমার জিনিস পত্রে হাত দাও কেন বলো তো? কোনো জিনিস তো গুছিয়ে রাখতে পারো না’!
ফীবিও ছাড়ার পাত্র নয়। খসখসে খোনা গলায় সেও চেঁচিয়ে ওঠে… ‘ আমাকে একদম মুখঝামটা দেবে না বলছি। তুমি যদি এমনই পাগলামি কর তাহলে কিন্তু যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাব। তখন তোমার কী হাল হবে ভেবে দেখেছ? তোমার ছুরি যেখানে বরাবর থাকে সেখানেই আছে। ঐ তাকের ওপর। ওটার কি ডানা গজাবে নাকি? তবে তুমি যদি আলাদা কোথাও রেখে থাকো তাহলে আমার কিছু করার নেই’।
বউ যতই ভয় দেখাক না কেন হেনরি জানে ফীবি তাকে ছেড়ে আর কোথায় যাবে? আচ্ছা ফীবি যদি তার আগে মরে যায় তখন কী হবে। ভাবলেই ভয়ে কাঁটা হয়ে যায় সে। না না এমনটা হতে পারে না। এই একটা জিনিসকেই ভয় পায় সে। রাতের বেলায় চেয়ারের ওপর উঠে সে যখন পুরোনো ঘড়িটায় দম দেয় বা সামনের-পেছনের দরজাগুলোয় ঠিকমতো খিল আঁটা হল কিনা তা যখন দেখতে চায় তখন মনে মনে একটু আরাম পায়। যাক ফীবি তো এখানেই আছে। তার পাশে। বিছানায় গুটিসুটি মেরে কেমন শুয়ে আছে দেখো। রাতে ঘুম না এলে বিছানায় সে যখন ছটফট করে তখন ফীবির ঘুম ভেঙে যায়… ‘ কিছু লাগবে তোমার? চুপ করে শুয়ে থাকো। অমন মুরগির মতো ছটফট করছ কেন?’
‘ আমার ঘুম আসছে না ফীবি’।
‘ তাহলে অমন ছটফট কোরো না। আমাকে ঘুমোতে দাও’।
ফীবির কথা শুনে সে একটু নিশ্চিন্ত বোধ করে। ঘুমে চোখটা বুজে আসে। বিছানায় শুয়ে ফীবি এক গেলাস জল চাইলে সে গজগজ করে বটে…কিন্তু সেইসঙ্গে একটা ভরসা পায়…আনন্দও পায়। যাক ফীবি তার কাছেই আছে। কোনো দিন আগে ঘুম ভেঙে যায় ফীবির। সেই আগেভাগে ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালিয়ে রাখে। হেনরি উঠে দেখে কাঠ কাটা হয়ে গেছে। সব তার হাতের সামনে। এভাবেই নিজেদের শান্তির নীড়ে হাতে হাতে কাজ করে দিন কেটে যায় তাদের।
দিন চলে যায়। এখন আর বাড়িতে বিশেষ লোকজন আসে না। কমসে কম এখানে দশ বর্গ মাইল জুড়ে সব লোকে তাদের চেনে। মি. আর মিসেস রেইফস্নেইডার। একবারে খাঁটি সৎ মানুষ। ধম্ম কম্মেও মতি আছে। কিন্তু এই বুড়ো বুড়ির কাছে এসে কেই বা আর আমোদ পাবে? আজকাল চিঠিপত্রও লিখতে ইচ্ছে করে না। কাউকে দিয়ে আর লেখানোও হয়না। তবু কালেভদ্রে পেরাম্বেটন গ্রাম থেকে মেয়ের দু একখানা চিঠি আসে। কখনো সখনো দু এক জন বন্ধুও আসে তত্ত্ব তালাশ করতে। সঙ্গে কলাটা, মুলোটা, কেক, হাঁস বা মুরগির রোস্ট নিয়ে আসে। সেও কদাচিৎ।
দেখতে দেখতে বয়স বাড়ে। এক বসন্তের দিনে অল্প জ্বর এল ফীবির। সামান্য জ্বর গিয়ে দাঁড়ালো ভয়াবহ অসুখে। এই বয়সে অসুখ হলে সহজে আর সারতে চায়না। দিনে দিনে বিছানায় মিশে যায় ফীবি। পাশের শহর সুইনারটনে গিয়ে ডাক্তার ডেকে আনে হেনরি। খবর পেয়ে চেনাশোনা লোকজনেরা আসে। তারাই রুগির সেবার ভার তুলে নেয়। সবে চেষ্টা ব্যর্থ করে সেদিন হিমেল বসন্তের রাতে চলে গেল ফীবি। ঘন কুয়াশার মধ্যে ফীবির সঙ্গে গোরস্থানে গেল হেনরি… একেবারে ভাঙ্গাচোরা একটা মানুষ। গোরস্থানটাও কেমন যেন ভূতুড়ে…বেখাপ্পা পাইন গাছ কটা দাঁড়িয়ে রয়েছে শুধু। পেম্বারটনে মেয়ের বাড়ি চলে যেতে পারত হেনরি…কিংবা মেয়েকেও তার বাড়িতে ডেকে পাঠাতে পারত। কিন্তু এই বয়সে সে আর কোনো ঝক্কি নিতে চায় না। এই জায়গাতেই থিতু হয়ে বসেছে সে। এখান থেকে নড়তে মন চায় না। বন্ধু বান্ধবেরাও তাদের বাড়িতে কিছুদিন থাকার জন্য অনেক করে বলল। কিন্তু সে রাজি নয়। এ বাড়ির প্রতিটা ইট কাঠ পাথরের সঙ্গে একেবারে জড়িয়ে গেছে সে। এই বয়সে সে আর ঠাঁইনাড়া হতে পারবে না। ফীবি যেখানে মাটির তলায় চিরঘুমে রয়েছে তার পাশাপাশি থাকতে পারলে মনে মনে শান্তি পাবে সে। একা একা থাকতে তার কোনো কষ্ট নেই। ছেলে মেয়েদের খবর দেওয়া হল। তারাও বাবাকে ডাকাডাকি করল। কিন্তু হেনরির সেই এক গোঁ। এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না । ফীবির চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন ডা.মরো। তাঁর সামনেও হেনরির সেই একই কথা… ‘ আমি একা চালিয়ে নিতে পারব। একটু আধটু রান্না বান্না তো জানি। সকালে আমার একটু কফি আর রুটি হলেই চলে যায়। আমার কোনো অসুবিধে হবে না। আমাকে শুধু নিজের মতো থাকতে দিন’। পাড়া প্রতিবেশিরা বলল তারা সময়ে সময়ে কফি, মাংস, পাঁউরুটি দিয়ে যাবে। এতে হেনরি রাজি। এ বাড়িতে তার একাই দিন কাটতে লাগল। অলস সময় যেন আর কাটে না। বসন্তের নরম রোদে মাঝে মাঝে গা ডুবিয়ে বসে। কত হাবিজাবি চিন্তা আসে মাথায়। একবার ভাবে সময় কাটানোর জন্য এবার একটু চাষবাসে মন দিলে হয়। অনেকদিন হল কিচ্ছু চাষ বাস হয়নি। এতে সময়টাও কাটবে। মনটাও অন্যদিকে ব্যস্ত থাকবে। বিকেল আর সন্ধেটায় সময়যেন আর কাটতে চায় না। এ বাড়ির প্রতিটা জিনিসে ফীবির হাতের ছোঁয়া। কিন্তু মানুষটা আর নেই। একটু একটু করে ফীবির সব জিনিসপত্র সে সরিয়ে ফেলেসে। ওগুলোর দিকে তাকালেই মনটা ভারি হয়ে যায়। রাতের বেলা লম্ফটা জ্বালিয়ে সে পুরোনো খবরের কাগজ পড়ে। বাইবেল পড়ে। অনেকদিন হল বাইবেলটা আর তাক থেকে নামানোই হয়নি। খুব ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু ধম্ম কম্মেও মনে একটুও শান্তি পায় না সে। বেশির ভাগ সময়ই মুখটা দু হাতে চেপে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর শুধু ভাবে। কোথায় গেল ফীবি? যে কবে ফীবির কাছে যেতে পারবে? কবে?
অনেক কষ্ট করে সকালে একটু কফি বানায় রাতে একটু মাংস রোস্ট করে নেয়। কিন্তু আজকাল আর খিদে হয়না। খাওয়ার ইচ্ছেটাই চলে গেছে। যে ছোট্ট ঘরটায় সে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে বাইরে থেকে দেখে মনে হয়না যে সেখানে কেউ থাকে। বাড়িটার চাপাশে বিষাদের ছাপ। শোকতাপে কেটে গেল পাঁচ পাঁচটা মাস। তারপর হঠাৎসবকিছু বদলে গেল।
রোজকার মতো সেদিন রাতেও সামনের আর পিছনের দরজাটা ভালো করে দেখে নিল হেনরি। দম দিল ঘড়িতে। লম্ফটা নিভিয়ে দিল। এই এত বছর ধরে যন্ত্রের মতো যা যা করেছে সব করে বিছানায় এল সে। ঘুমোয় সে আর কতটুকু! সারাক্ষণ তো ভেবেই যায়। বাইরে চাঁদের আলোর বন্যা। বাইরের বাগানে শ্যাওলা ঢাকা গাছের গুঁড়িগুলো যেন চক চক করছে। বিছানায় শুয়ে বাইরের জানালা দিয়ে সব দেখতে পাচ্ছে সে। গাছগুলোকে দেখে ছায়ামানব বলে ভ্রম হয়। পূবের জানালার জাফরি দিয়ে চাঁদের আলো মেঝেতে বিচিত্র আঁকিবুঁকি কেটে চলেছে। ঘরের মান্ধাতার আমলের আসবাবগুলোর ওপরও আলো পড়েছে। বিছানার শুয়ে শুধু ফীবির কথাই ভেবে যায় হেনরি। সেই কম বয়সে তাদের ঘরকন্নার কথা…ছেলে মেয়েদের কথা। কেউ আর কাছে নেই তারা। যে যার মতো দূরে চলে গেছে। এই একলা ঘরে ফীবির স্মৃতি বুকে আঁকড়েই পড়ে রয়েছে সে। ঘরের অবস্থা একেবারে অগোছালো। কোনো যত্ন নেই। বিছানার চাদরটাও ময়লা হয়ে গেছে। কাচাকুচি মোটেই পারে না সে। কাচার কথা ভাবলেই গায়ে জ্বর চলে আসে । বাড়ির ছাদে ফাটল ধরেছে। জিনিসপত্র সব স্যাঁতসেঁতে হয়ে থাকে। এসব সারানোর দিকে তার কোনো মন নেই। সারাক্ষণ নিজের চিন্তাতেই সে বুঁদ। আলগোছে একদিক ওদিক হেঁটে এসে আবার নিজের চিন্তাতেই ডুবে যায় ।
সেদিন বারোটা নাগাদ ঘুমিয়ে ছিল সে। দুটোতেই ঘুম ভেঙে গেল। চাঁদটা এখন পশ্চিমে হেলে পড়েছে। বসার ঘরের জানালা দিয়ে আলো এসে পড়েছে। রান্নাঘরটাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আলোয়। বাড়ির সব আসবাব…চেয়ার টেবিল…চেয়ারের মাথায় রাখা তার কোট…রান্নাঘরের আধখোলা দরজা… রুপোলি আলোয় সব যেন মায়াবী লাগে। এযেন আলো ছায়ার খেলা। খবরের কাগজের কাছে ওই লম্ফের পাশে…কে বসে ও? এ যে ফীবি! অবিকল ফীবি! ফীবি টেবিলটার ওপর মাথা ঝুঁকে বসে আছে। ফীবিকে এইভাবে বসে থাকতে সে কতদিন দেখেছে। চমকে ওঠে হেনরি। কে ওই ছায়ামূর্তি ! ফীবি নাকি ফীবির প্রেতাত্মা! জীবনে সে কোনোদিনো ভূত প্রেতে বিশ্বাস করেনি। তাও আজ সে নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। আধো আলোয়…ঐ ছায়া মূর্তির দিকেই ঠায় তাকিয়ে থাকে সে। মাথার চুল খাড়া হয়ে যায়। ঐ ছায়া মূর্তির কোনো নড়ন চড়ন নেই। বিছানা থেকে নিজের সরু লিকলিকে পা দুটো নামিয়ে ছায়ামূর্তির দিকে নিষ্পলক তাকিয়েই থাকে। এ কী সত্যিই ফীবি! ভূত, প্রেত, আত্মা, অশুভ লক্ষ্ণণ নিয়ে আগে প্রায়ই তাদের মধ্যে কথা হত। কিন্তু তারা দুজনেই এসবে বিশ্বাস করেনি কোনোদিন। তার বউ কোনো দিনও বিশ্বাসই করত না যে সে আত্মা হয়ে আবার এই পৃথিবীতে ফিরে আসবে। এই জীবনের ওই পারে কী রয়েছে তা নিয়ে ফীবির কোনো স্পষ্ট ধারণাই ছিল না। সে শুধু ভাসাভাসা ভাবে জানত ওই পারে একটা স্বর্গের মতো কিছু একটা আছে। যারা সৎ, ভালো মানুষ তারা আর সেখান থেকে ফিরে আসে না। তবে সে এখানে কী করে এল! ওই তো টেবিলের ওপর মাথা ঝুঁকে বসে আসে সে। ওই তো তার কালো স্কার্ট…ছাই রঙা শাল। ওই তো তার আবছা অবয়বে আলো এসে পড়েছে। শিরদাঁড়া বেয়ে হিমস্রোত বয়ে যায় হেনরির, গলা ছেড়ে সে চেঁচিয়ে ওঠে… ‘ফীবি…তুমি আবার ফিরে এসেছ?’সে অবয়ব আর নড়ে না। স্থির হয়ে বসে থাকে। হেনরি উঠে ওই ছায়াকে লক্ষ্য করে দরজার দিকে পা বাড়ায়। সে একটু এগোতেই যেন বাতাসে মিলিয়ে যায় সে ছায়া। ঘরে শুধু পড়ে থাকে ভাঙাচোরা, ঘুণ ধরা সব আসবাব…চেয়ারের হাতলে সেই পুরোনো কোট, কাগজপত্রের মাঝখানে ওই সেই লম্ফ…ঐ সেই আধখোলা দরজা। ফীবির কোনো লেশমাত্র নেই। নিজের মনেই বিড়বিড় করে যায় হেনরি… ‘ আচ্ছা ঠিক আছে…আমি হলফ করে বলতে পারি সে এসেছিল’। মনটা একটু শান্ত হতে মাথায় একনাগাড়ে বিলি কেটে যায় সে। তার মনে দৃঢ় বিশ্বাস আজ নাহয় ফীবি ধরা দেয়নি। তবে ফিরে সে আসবেই।
আরেকদিন রাতেও সেই একই ঘটনা। তার চিন্তায় সারাক্ষণ ফীবি। বয়সকালে মাথায় কত রকমের চিন্তা যে আসে! বিছানার সবচেয়ে কাছের জানালা দিয়ে বাইরে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সে। বাইরে ওই তো মুরগির খাঁচা, শুয়োরের খোয়াড়…ঠেলা গাড়ি রাখার ছাউনি। ভেজা মাটি থেকে আবছা ধোঁয়াউঠে যায়। ওর মধ্যেই আবার সে দেখতে পায় ফীবিকে। হ্যাঁ হ্যাঁ সেই ঠিকই দেখেছে। রোদে পোড়া দিনের শেষে ঠান্ডা রাতে মাটি যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়। সেই নিঃশ্বাসই ধোঁয়ার পরত হয়ে আকাশে মিলিয়ে যাওয়ার আগে সাদা সাইপ্রেস গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। ফীবি তো আগে কতবার রান্না ঘরের এঁটো কাঁটা…কুটনো কাটনা ফেলতে ওই রান্নাঘরের দরজা দিয়ে খোঁয়াড়ের দিকে যেত। বিছানায় উঠে বসে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে হেনরি। মনে একটু সংশয়। আগের বারের মতো আবার সে চলে যাবে না তো? মন আজ তার বড় চঞ্চল হয়ে উঠেছে। হ্যাঁ আত্মা বলে নিশ্চয় কিছু আছে। এই কথাটা এত দিনে তার বিশ্বাস হয়েছে। ফীবিও হয়তো তার ফেলে আসা সঙ্গীর কথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছে। মনে মনে হয়তো ভাবছে আহারে বেচারা হেনরি কীভাবে একা একা দিন কাটাচ্ছে! এত দিনের সঙ্গীর মায়া কাটাতে না পেরে সে হয়তো আবার ফিরে এসেছে। আর কী করতে পারে সে? নিজেকে আর কীভাবে সে প্রকাশ করতে পারে? হেনরির এত কষ্ট দেখে এইটুকু দয়া সে করবে না? হেনরি একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে জানালার দিকে। তপ্ত মাটির নিঃশ্বাস ধোঁয়া হয়ে কাঁপতে কাঁপতে সরে যায় ওই বেড়ার দিকে ।
এর পরের ঘটনা দশ দিন পরে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নের ঘোরে আবার তার কাছে ফিরে আসে ফীবি। বিছানায় তার পাশে বসে মাথায় হাত রাখে ফীবি… ‘ আহা বেচারা হেনরি…নিজের কী দশা করেছে দেখো!’
ধড়ফড় করে উঠে বসে হেনরি। তাকে সে স্পষ্ট দেখেছে যে! ওই তো সে শোওয়ার ঘর থেকে বসার ঘরের দিকে চলে গেল। কালো আবছা মতো তার শরীর। তার শরীরের রেখা থেকে কেমন বিন্দু বিন্দু আলো ঠিকরে পড়ছে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় সে! এ কী সত্যি! বিছানা থেকে উঠে বরফ ঠান্ডা মেঝেতে অস্থির হয়ে পায়চারি শুরু করে দেয়। মনে মনে অনেক ভাবনা খেলা করে যায়। হ্যাঁ সে এবার সে নিশ্চিত ফীবি তার কাছেই ফিরে আসছে। সে ফীবির কথা সময় ভাবে আর ওপার থেকে ফীবি যদি বুঝতে পারে সে ছাড়া তার স্বামী কত অসহায় তাহলে সেকি না এসে পারবে? এতটুকু করুণা সে কি তার হেনরির ওপর করবে না? ফীবি নিশ্চয়ই তাকে বলে দেবে কী করতে হবে না হবে। রাতেই হয়তো ফীবি তার কাছে আসবে। তাতে তার একাকীত্ব তো অন্তত ঘুচবে। এই নির্জনবাস যে সহ্য হয় না আর।
একেতে এত বয়স…তার ওপর দুর্বল শরীর মনের ভ্রম হওয়াটা স্বাভাবিক। মনের বিকার থেকে কল্পনায় নানা দৃশ্য দেখতে শুরু করে সে। এই করে করে পুরো বদলে যায় মানুষটা। রাতের পর রাত সে জেগে থাকে ফীবির অপেক্ষায়। কখনো তার তার মনে হয় একটা আলোময় শরীর ঘরের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবার কখনো দিনের আলো নিভলে বাগানের মধ্যে ফীবিকে পায়চারি করতে দেখে। একদিন সকালে উঠে পাগল পাগল লাগে তার। এই একাকীত্বের বোঝা বয়ে বেড়ানো যে কী কষ্টের! এতদিনে সে ঠিক ধরতে পারেছে ফীবি আসলে কাছাকাছিই আছে…সে মরেনি। কেন যে তার এমনটা মনে হল সেটা অবশ্য বলা শক্ত। মাথাটা তার একদম গেছে। দিনরাত কল্পনার রাজ্যেই ডুবে থাকে সে। নিজের মনেই ফীবির সঙ্গে আবোল তাবোল ঝগড়া করে। খুব ধমক দেয় সে ফীবিকে…কেন তার তামাকের পাইপটা সরানো হয়েছে! কেন সেটা ঠিক জায়গায় নেই। সঙ্গে সঙ্গে ফীবি চলে যায়। সে তো আগে মাঝেমাঝেই নিজের বরকে কপট রাগ দেখিয়ে বলত… ‘তুমি যদি এমন করো তাহলে আমি কিন্তু চলে যাব’! তার উত্তরে হেনরি বলত… ‘ ও ঠিক আমি তোমায় খুঁজে বের করে ফেলব’। ফীবিও কি কম যেত নাকি! সেও ঝাঁঝিয়ে বলে উঠত… ‘ আমি তোমায় ছেড়ে চলে গেলে কোত্থাও পাবে না তুমি আমায়। আমার এমন জায়গা জানা আছে যেখানে তুমি আমায় শত খুঁজেও পাবে না।
সেদিন সকালে উঠে আর আর কিচ্ছু করতে ইচ্ছে করে না তার। ফায়ার প্লেসে আগুন দিতে ভুলে যায়…রোজকার মতো কফি বানিয়ে রুটি খেতেও আর মন চায় না। এখন মনে তার একটাই চিন্তা এই কাছাকাছির মধ্যে ফীবি কোথায় যেতে পারে? সে কোথায় গেছে একবার জানতে পারলেই বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে আসা যাবেখন। এই তো কিছুদিন আগেই ঘোড়াটাকে বেচে দিয়েছে সে। একা মানুষ। তার ওপর একটা ঘোড়া থাকা মানেই ঝক্কি। জামাকাপড় পরে মাথায় নরম কাপড়ের টুপিটা চাপিয়ে দরজার পেছনের আংটা থেকে বেতের প্যাঁচালো লাঠিখানা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে। তার চোখে মুখে এখন নতুন উদ্যম…নতুন সংকল্প। ফীবিকে সে খুঁজে বের করবেই। কোথায় আর সে যেতে পারে। আশে পাশের কোনো পড়শির বাড়িতে হয়তো গিয়ে বসে আছে। ধুলোভরা পথে ছেঁড়াখোড়া জুতো নিয়ে থপথপিয়ে সে হেঁটে যায়। অনেক দিন চুল টুল কাটা হয়নি। আধপাকা চুল এখন ঘাড় অবধি নেমে এসেছে। টুপির বাইরে ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল বেরিয়ে এসেছে। মনে হচ্ছে যেন কোনো দেবদূতের মাথার জ্যোতির্বলয়। সে হেঁটে যায় হার বাতাসে পতপত করে ওড়ে তার খাটো কোট। মুখ…চোখ…দুহাত একেভারে যে রক্তশূন্য…ফ্যাকাশে।
রাস্তায় ডজের সঙ্গে দেখা। ডজ এখানেই চাষবাস করে। গাড়িভর্তি গম নিয়ে সে চলেছে বাজারে। এতদিন বাদে রাস্তায় হেনরিকে দেখে ডজ তো অবাক…বউ মরার পর এই মানুষটা আর ঘর থেকেই বেরোয়নি। আজ আবার সে মানুষটা এত হন্তদন্ত হয়ে যাচ্ছেকোথায়?
‘ এই যে হেনরি এত সকাল সকাল চললে কোথায়?’
‘ তুমি কি ফীবিকে কোথাও দেখেছ?’…বুড়ো মানুষটার মুখে গভীর উদ্বেগ।
‘ কোন ফীবি?’…হেনরির বউ ফীবির কথা তো মাথাতেই আসেনি গোবেচারা ডজের।
‘ আমার বউ ফীবি। আর কার কথা বলব আমি শুনি?’…উস্কো খুস্কো চুল…এবড়ো খেবড়ো ভুরুর নীচে মানুষটার চোখদুটো বড় করুণ লাগে।
ডজ সাদাসিদে মানুষ। গোলগাল…মুখখানা রাঙামূলোর মতো। মনে কোনো ঘোরপ্যাঁচ নেই…সেও বোকার মতো বলে বসে… ‘হেনরি তুমি নিশ্চয়ই মস্করা করছ তাই না… তুমি কি সত্যিই তোমার বউয়ের কথা বলছ…সেতো কবে মরে ভূত…
হেনরির এখন মাথার ঠিক নেই। ডজের কথা শুনে চোটে লাল… ‘ না আজই সকালে ও বেরিয়েছে। আমি তখন ঘুমোচ্ছিলাম তাই টের পাইনি। ও বরাবর আমার আগে ঘুম থেকে উঠে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করে। কাল রাতে একটু ঝগড়া হয়েছিল। তাই সে আজ রাগে চলে গেছে। তবে আমি ওকে ঠিক খুঁজে বের করব। ও নিশ্চয়ই মাটিল্ডা রেসের বাড়ি গেছে। ওখানে তো ও মাঝে মাঝে যায়’।
হনহনিয়ে হয়ে আবার হাঁটা দেয় সে। কোনোদিকে তাকায় না। বোকা চাষি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে বুড়োর দিকে। নিজেই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে… ‘ এ কী কাণ্ডরে বাবা! বুড়োর মাথাটা একদম গেছে। ঘরে একা থাকতে থাকতে বুড়ো কি পাগল হয়ে গেল নাকি? যাই হোক আমাকে ব্যাপারটা শেরিফকে জানাতে হবে’। এই বলে অতি আগ্রহে ঘোড়াটাকে সপাৎ করে মারে এক চাবুক… ‘ জলদি চল’।
এই গ্রামে লোক জন বিশেষ থাকে না। পথে আর আর কারো সঙ্গেই দেখা হল না। কখন যে সে তিন মাইল হেঁটে মাটিল্ডা রেসের বাড়ি পৌঁছে গেল নিজেই টের পেল না। ওই তো মাটিল্ডা রেসের বাড়ির সামনে সাদা বেড়াটা দেখা যাচ্ছে। পথে আরো কয়েকটা বাড়ি অবশ্য চোখে পড়েছে কিন্তু এদের কারো বাড়িতে ফীবি যেতে পারে বলে তার মনে হয়না। মাটিল্ডার সঙ্গেই ভালো ভাবসাব ছিল ফীবির। এলে সে এখানেই এসেছে। বেড়ার গেটটা খুলে ভারী হন্তদন্ত সে দরজায় এসে ধাক্কা দেয়। দরজা খুলে তাকে দেখে মাটিল্ডাও বেশ অবাকই হয়… ‘ কী ব্যাপার মি.রেইফস্নাইডার? এখানে? এত সকাল সকাল? আর তর সয়না হেনরির ‘ ফীবি এখানে এসেছে’? প্রশ্ন শুনে মাটিল্ডার মতো শক্তপোক্ত মানুষেরও চোখ কপালে!
‘ কোন ফীবি? কীসের ফীবি? বুড়োর চোখ মুখের অবস্থা দেখে তার জানার খুব কৌতূহল হয়। ব্যাপারটা আসলে কী? একটু বাজিয়ে দেখতে হচ্ছে তো!
‘ অবশ্যই আমার ফীবি। আমার বউ ফীবি। আর কোন ফীবির কথা বলব বলে আপনার মনে হয়? ও কি এখানে রয়েছে?’
‘ হে ঈশ্বর! এ কেমনতরো কথা। আপনার এখন মাথার ঠিক নেই। আপনি এখন বসুন তো। একটু কফি টফি খান। আপনার বউ তো এখানে আসেনি। তাতে কী। আপনি ভেতরে এসে একটু বসুন। একটু পরেই আমি আপনার বউকে খুঁজে দেব। সে কোথায় যেতে পারে আমার জানা আছে’।
বুড়ো মানুষটার চোখে টলটলে জল। সে ভেতরে ঢোকে। মাটিল্ডা ভাবে কী চেহারা হয়েছে মানুষটার! শরীরের সবকটা হাড় যেন গুণে ফেলা যায়। চোখ মুখ ফ্যাকাশে। তার ওপরে অমন ঢলঢলে একটা প্যান্ট! তাকে দেখে নিজের বুড়ো বাপটার কথা মনে পড়ে যায় মাটিল্ডার। মানুষটা যখন টুপিটা খুলে হাঁটুগেড়ে মাটিতে বসে পড়ে তখন খুব কষ্ট হয় তার। আহারে!
‘জানেন তো কাল রাতে আমাদের ওই একটু ঝগড়াঝাঁটি হয়েছিল। সেইজন্য সকালে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে ফীবি’।
‘ হে ভগবান!’ নিজের মনেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মাটিল্ডা। এখন বাড়িতে কেঊ নেই যে তাকে এই কথাটা বলে নিজে একটু হাল্কা হওয়া যায়। তড়িঘড়ি রান্নাঘরে এসে নিজের মনেই বিড়বিড় করে সে… ‘মানুষটাকে দেখলে কষ্ট হয়। ওঁর একটু দেখাশোনা…যত্ন আত্তি করা দরকার। কবে বউ মরেছে। আর উনি এভাবে পাগলের মতো মাঠে ঘাটে ছুটে ছুটে বেড়াবেন। না, এ কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না’।
জলদি কফিটা বানিয়ে নেয় সে। বাড়ির তৈরি রুটি আর একটু মাখনও আনে। তার সবচেয়ে ভালো জ্যামটাও বের করে। আর দুটো ডিম সেদ্ধ করতেও বসিয়ে দেয়।
‘ কাকু আপনি এখন এখানে আসুন। জ্যাক বাড়ি ফিরে আসুক। আমি নিজে ওকে ফীবিকে খুঁজতে পাঠবো। আমার তো মনে হয় সইদের নিয়ে তিনি সুইনারটনদের বাড়িতেই গেছেন। যাই হোক না কেন আমারা ঠিক খুঁজে ফেলব। নিন এখন এখন একটু কফি আর রুটি খেয়ে নিন দেখি। বড্ড ধকল গেছে আপনার ওপর দিয়ে। সকাল সকাল এতদূর হেঁটে এসেছেন!’ মাটিল্ডা আসলে এটা ওটা বলে বুড়োকে ভুলিয়ে রাখতে চায়। আগে তার মরদ জ্যাক ফিরুক ঘরে। তার সঙ্গে একটু আলাপ আলোচনা করে না হয় দেখা যাবে। আসলে শেরিফকে তো ব্যাপারটা জানাতে হবে। জ্যাককেই ওখানে পাঠাতে হবে। কেমন যেন মনটা আনচান করছে তার। সে ভাবে দু দিনের এই জীবনে কতকিছু যে ঘটে যেতে পারে আগে থেকে কে বলতে পারে! ওদিকে হেনরি তার ফ্যাকাসে হাত দিয়ে টুপিটায় হাত বুলোতে বুলোতে খাবার দাবারগুলো খেয়েই নেয়। বড় অন্যমনস্ক সে। ফীবিকে ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছে না। ফীবি এখানে আসেনি। তাহলে কোথায় যেতে পারে সে! কার বাড়ি? ভাবতে ভাবতে স্মৃতির অতল থেকে হঠাৎ করে মুরেদের কথা মনে পড়ে যায়। আচ্ছা ও বাড়িতে কি ফীবি গেছে! সে বাড়ি এখান থেকে আবার এক মাইল। তাও আবার পুরো উলটো দিকে। এখানে অনেক্ষণ কেটে গেছে জ্যাকের জন্য অপেক্ষা করে লাভ নেই। সে নিজেই তার বউকে খুঁজে বের করবে। তাকে যে যেতেই হবে। ফীবির মানভঞ্জন করতে হবে। তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতেই হবে।
‘ না এবার আমায় যেতেই হবে’…ছটফট করে উঠে পড়ে হেনরি। নিজেই কেমন বেকুব বনে যায়… ‘এখানে তো ফীবি আসেনি। আমার মনে হয় ও মুরেদের ওখানেই গেছে। আমি আর দাঁড়াতে পারব না মিসেস রেস। বাড়িতেও মেলা কাজ পড়ে রয়েছে’।
মাটিল্ডার শত অনুরোধেও সে গলে না। বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। এখন বসন্তের গনগনে রোদ। মাটিতে বেতের লাঠিটা ঠক ঠক বুড়ো পথ চলেই যায়।
ঘণ্টা দুয়েকপর ফ্যাকাশে…হা ক্লান্ত মানুষটা এসে দাঁড়ায় মুরে-দের দরজায়। ঘামে ভেজা সারা শরীর ধুলোয় ভর্তি। এই রোদে তাতে পাঁচ মাইল হেঁটে ফেলেছে সে। মুর দম্পতিরও বয়স হয়েছে। মিসেস মুরের বয়সই তো ষাট হয়ে গেল। হেনরির প্রশ্ন শুনে তাঁদেরও ভিরমি খাওয়ার যোগাড়। সত্যিই পাগল হয়ে গেছে মানুষটা। দুপুরে খেয়ে যাওয়ার জন্য তারাও অনেক পীড়াপীড়ি করেন । তার পর নাহয় সবাই মিলে ফীবিকে খুঁজবার জন্য কিছু একটা করা যায়। আসলে তাদের উদ্দেশ্যটা ছিল একটু অন্য। এই ফাঁকে পরে যদি ব্যাপারটা শেরিফের কানে তুলে রাখা যায়! এদের অনুরোধে একটু বসে হেনরি। আনমনে অল্প কিছু খেয়েও নেয়। তারপর আবার উঠে দাঁড়ায়। এখানে বসে থাকলে তার চলবে না। এবার তাকে অন্য কারো বাড়িতে খুঁজতে হবে। সে যত দূরই হোক না কেন! ফীবিকে ছাড়া তার চলবে না। তার এই চাওয়াই ক্ষ্যাপার মতো ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায় তাকে। সেদিন বটেই তার পরদিন…তারও পরদিন চলে এর ওর বাড়িতে তার এই ঘোরাঘুরি…আর সেই একই জিজ্ঞাসা ‘ ফীবি কি এসেছে এখানে?’
হেনরির যে সমাজে বাস সেখানে তার এই পাগলামি, উদ্ভট সব রকম সকম তো আর চলে না। হেনরি নাহয় কারো ক্ষতি করে না। তাকে দেখে লোকের কষ্টই হয়। অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও লোকের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তার প্রশ্ন শুনে লোকে অবাক হয়…তারপর এই অসহায় মানুষটার জন্য করুণা। গ্রামের শেরিফকে ব্যাপারটা জানানো হয়েছে। এ রকম অবস্থায় যে কোনো লোককেই পাগলাগারদে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু এই বুড়ো মানুষটার ব্যাপারটা একটূ আলাদা। তাকে অনেকে অনেকদিন ধরেই জানে। তারাও জানে গ্রামের পাগলা গারদের অবস্থা কী শোচনীয়! মানুষে থাকতে পারে না সেখানে। ভেতরে ঢুকলেই গা গুলিয়ে আসে। এই গ্রামের হত দরিদ্র অবস্থা। যেখানে বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন লড়াই করতে হয়…সেখানে পাগলা গারদের হাল ফেরানোর দিকে কে আর নজর দেয়? গ্রামের মাথারা তাই রায় দিলেন হেনরি তার নিজের মতোই থাকুক। লোকে খোঁজ নিয়ে জেনেছে সারা দিনের ঘোরাঘুরির পরে সে বুড়ো মানুষটা রাতে ঠিক নিজের আস্তানাতেই ফিরে যায়। সেখানে গিয়ে তন্ন তন্ন করে দেখে তার বউ ফিরে এসেছে কিনা। তার একা ঘরে সারারাত নিজের কল্পনার রাজ্যে ভাসতে ভাসতে আবার বেরিয়ে পড়ে পরের দিন সকালে। ফীবির খোঁজে। এমন একজন রোগা পাতলা শান্ত নিরীহ মানুষকে কি পাগলা গারদের অন্ধ কুঠরিতে বন্ধ করে রাখা যায়? মানুষটার বয়স হয়েছে। চুল গুলো একেবারে শনের নুড়ি। দোষের মধ্যে তিনি সবাইকে তাঁর বউয়ের খবর জিগ্যেস করে বেড়ান। সবাই তাকে অতি ভদ্র, সজ্জন বলেই যায় জানে। শুধু একটু প্রশ্ন করার জন্য তাঁর এতবড় শাস্তি হতে পারে না। তিনি নিজের মতোই থাকুন। তাঁর পুরোনো পরিচিতরা সবাই এই রায়ই দেয়। ও তো কারো কোনো ক্ষতি করতে যাচ্ছেনা। অনেকে আবার তাঁকে সাহায্য করবেও বলে। খাবার দাবার, পুরোনো জামা কাপড়, আর বেঁচে থাকতে গেলে আর যা যা কিছু লাগে…সেগুলো দেওয়ার কথা অনেকেই জানায়…বিশেষ করে খাবারটা।
দিন যায়। এখন সবাই মোটামুটি চিনে গেছে তাঁকে। মানুষটা কী জিগ্যেস করতে পারে সেটাও সবার জানা। তাই এখন হেনরিকে দেখলেই সবাই আগে ভাগেই উত্তর দিয়ে দেয়… ‘ না আমি তো তাকে দেখিনি’… ‘ হেনরি আজ তো ও আমাদের বাড়ি আসেনি’। প্রতিদিন সেই একই প্রশ্ন আর একই উত্তর।
বেশ কয়েক বছর ধরে চলে তার এই খোঁজ । রোদে জলে ধুলো কাদায় সে ঘুরে বেড়ায় পরিব্রাজকের মত…মনে শুধু একটাই প্রশ্ন। গ্রাম ছাড়িয়ে দূর দূরান্তে যেখানে পারে সে চলে যায়। তবু শেষ হয়না তাঁর খোঁজ। খাওয়া নেই, দাওয়া নেই। শরীর ভেঙে পড়ে। পড়শিরা যতটা পারে সাহায্য করে। কোনোদিন সে খায়…কোনোদিন খায়না। সারাদিন শুধু হাঁটা। রাস্তা ধরে সে যত হাঁটতে থাকে কল্পনায় তত ছবি দেখতে পায়। এতদূর হেঁটে বাড়ি ফিরতে আর খুব কষ্ট হয়। এবার একটা উপায় বের করে ফেলে সে। একটা পোঁটলায় বাসন কোসন সব বেঁধে নেয়… কফির পুরোনো টিনের বড় কেটলি, টিনের একটা ছোট পেয়ালা, একটা ছুরি, কাঁটা চামচ, আর একটু নুন আর মরিচ। পোঁটলার মধ্যে একটা ফুটো করে দড়ি দিয়ে একটা থালা বেঁধে নেয়। এই থালাটা যখন তখন বের করে নেওয়া যাবে। বনে জঙ্গলে এটাকেই দিব্যি টেবিল হিসাবে চালিয়ে নেওয়া যাবে। এই জিনিসগুলো সঙ্গে থাকলে তাকে তার বাড়ি ফেরার ধকল নিতে হয় না। সে খায় পাখির মতো। এইটুকু খাবার যোগাড় করতে তার তেমন অসুবিধে হবে না। আর লোকের কাছ থেকে একটু খাবার চাইতে তার কোনো লজ্জা নেই। তার চুল বাড়তে বাড়তে কাঁধ ছুঁয়ে ফেলে। তার কালো টুপি রোদে পুড়ে একদন বাদামি। তার জামা কাপড় ছিঁড়ে ফর্দাফাই। সারা শরীর ধূলোময়।
আজ তিন বছর হয়ে গেল। সে শুধু খুঁজেই চলেছে। কত শত মাইল পথ যে সে হেঁটে ফেলেছে… কেউ জানে না। এত ঝড় জল তুষারপাতের মধ্যেও তার প্রাণটা কীভাবে টিকে রয়েছে সেটাও গ্রামের সাধারণ সাদাসিদে মানুষগুলোর মাথায় ঢোকে না। যেখানে সেখানে রাত কাটিয়ে দিতে পারে সে। খড়ের গাদায়…গোয়াল ঘরে গরু, বাছুর, শুয়োরের পাশে ঘেঁসাঘেঁসি করে দিব্যি সে ঘুমিয়ে পড়ে। পশুগুলোর গায়ের উষ্ণতায় সে একটু ওম পায়। এমন একটা নিরীহ, অসহায় মানুষকে দেখে পশুগুলোরও বোধহয় মায়া হয়। তারাও দিব্যি মেনে নেয় এই সহাবস্থান। ঝড়, জলের সময় কখনো সে আশ্রয় নেয় পাহাড়ের গুহায় বা কোনো বড় গাছের ছায়ায়। খড় বা ভুট্টা রাখার গোলাঘরেও মাঝে মাঝে তার আশ্রয় জুটে যায়।
দিনে দিনে তার মনের বিকার আরো বাড়ে। রোজ রোজ লোকের বাড়ি ঘুরে ঘুরে ‘না’ শুনতে এখন আর তার ভালো লাগে না। কোনো বাড়িতেই ফীবিকে সে খুঁজে পায়নি। কিন্তু ফীবি ঠিক কোথাও না কোথাও রয়েছে। তেমন করে ডাকলে সে শুনতে পাবে। লোকের বাড়ি ঘোরা ছেড়ে সে এখন সে ফীবির নাম ধরে চিৎকার করে ডাকে। এই শান্ত মাঠে ঘাটে…খাড়া পাহাড়ি অঞ্চলের ধাপে ধাপে গুমরে ওঠে তার বুকফাটা কান্না… ‘ ও… ফীবি…ও… ফীবি…!’ তার এই কান্না সবাই শুনে ফেলেছে। দূর দূরান্তের চাষি আর আর তাদের মুনিষরাও মানুষটাকে চিনে নিয়েছে… ‘ ঐ যে বেচারা রেইফস্নেইডার’।
এতদিনে কয়েক হাজার লোককে জিগ্যেস করা হয়ে গেছে। কয়েকশ বাড়িতে ঢুঁ মারা হয়ে গেছে। এবার আর কোনো বাড়িও চোখে পড়ে না। কোন রাস্তা ধরে সে যাবে তাও জানা নেই। বিশেষ করে চৌমাথা বা ছয় মাথার রাস্তাগুলিতে এসে তার মাথাটা একেবারে গুলিয়ে যায়। এবার সে কোনদিকে যাবে? এবার তার মাথায় আসে আরো উদ্ভট কল্পনা। ফীবীর আত্মা তাকে পথ দেখাবে… কিংবা প্রকৃতির কোনো শক্তি…হাওয়া… ঝড়…তাকে ঠিক ফীবির কাছে নিয়ে যাবে। সে এই ধরনের চৌমাথা বা ছয় মাথা রাস্তার ঠিক মধ্যিখানে এসে দাঁড়ায়। চোখ বন্ধ করে নিজে তিনবার ঘুরে নেয়। তার পর দুবার ডেকে ওঠে … ‘ ও… ফীবি’। তারপর লাঠিটাকে সোজাসুজি ছুঁড়ে দেয়। লাঠিটা যে রাস্তায় গিয়ে পড়বে সেটা ধরে গেলেই ঠিক ফীবির দেখা মিলবে। কোনো দৈব শক্তি নিশ্চয়ই তাকে সঠিক রাস্তার খোঁজটা দেবে। এমনটাও হয়েছে সে রাস্তায় সে হাঁটা শুরু করেছিল ঘুরে ঘুরে আবার সেখানেই ফিরে এসেছে। কতদূর সে হেঁটেছে মনে মনে সেটাও ঠাওর করতে পারে না। তাই ফীবিকে আবার ডাক দেওয়ার আগে পুরো জায়গাটা সে তন্ন তন্ন করে খুঁজে নেয়। একটা বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেছে তার মনে ফীবিকে সে ফিরে পাবেই। হাঁটতে হাঁটতে পা ক্ষত বিক্ষত হয়। ব্যাথায় পা টনটন করে। প্রখর রোদে সারা গা হাত জ্বলে যায়। সে হাত দিতে ভুরুর ঘাম ঝাড়ে। আবার প্রবল শীতের দিনে শরীর গরম রাখতে শুধু হাত ঘসে যায়।
অনেক সময় লাঠিটা গিয়ে সেই রাস্তার দিকেই পড়ে যেখান থেকে এই মাত্র ঘুরে এসেছে। মাথাটা ঝাঁকিয়ে সে দার্শনিকের মতো ভাবে…ভাগ্যে কী লেখা আছে কেউ কি আর বলতে পারে। আবার সেই রাস্তা ধরে সে হাঁটতে শুরু করে।তিন চারটে গ্রাম তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়ে গেছে তার। ছেলে বুড়ো এখন তাকে সবাই চেনে। সবাই তাকে দেখে আহা ঊহু করে। লোকের মুখে মুখে তার নাম ঘোরে।
গ্রিন কাউন্টির কাছে একটা ছোট্ট শহর আছে ওয়াটার্সভিল। ওখানে মানুষের বসতির মাইল চারেক দূরে একটা খাড়াই পাহাড় আছে। স্থানীয় লোকজনেরা বলে রেড ক্লিফ। লাল বেলে পাথপাথরের এই পাহাড়টা একশো একশো ফুট মতো উঁচু হবে। ভুট্টার ক্ষেত আর ফলের বাগানের মধ্যে প্রায় আধ মাইল জুড়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে এই পাহাড়। পাহাড়ের ওপর ঘন গাছ গাছালি। উলটো দিকে পাহাড়ে ওঠার যে ঢালটা রয়েছে সেখানে কত গাছ…বীচ, হিকোরি অ্যাশআরো কত কী। এই গাছ গাছালির মধ্যে দিয়ে ফসলের গাড়ি চলাচলের চিহ্ন রয়েছে। আবহাওয়া ভালো থাকলে কোনো বড় গাছের নীচে বিছানা করে নেয় হেনরি। এটাই এখন তার অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। তারপর কোনো একটা গাছের নীছে আগুন জ্বালিয়ে মাংসটা একটু ভেজে নেয় বা ডিমটা সেদ্ধ করে নেয়। তারপর গাছের নীচেই শুয়ে পড়ে। এখন আর ঘুমও হয় না ভালো করে। ঘুম না এলে সে পায়চারি করে বেড়ায়। ঝিকিয়ে ওঠা চাঁদের আলো মুখে পড়ে তার ঘুম ভেঙে যায়। কখনো বা দামাল বাতাসে, আবার কখনো রাতচরা পশু-পাখির ডাকে সে ধড়ফড় করে উঠে বসে। বসে বসে শুধু চিন্তাই করে যায়।আঁধার রাতেও তার চলা থামেনা। জ্যোৎস্না ঝলমলে রাতেও তার একটাই মন্ত্র…চরৈবেতি। অদ্ভূত, বুনো, উন্মাদের মতো একটা লোক…অথচ সে কারো ক্ষতি করে না। রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে সে করুণ বিলাপ করে…অন্ধকারে একদৃষ্টে দরজা-জানালা বন্ধ হয়ে যাওয়া বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। আর মনে মনে ভাবে এর মধ্যে কোন বাড়িতে তার ফীবি থাকতে পারে।
রাত দুটোর সময় তার ঘুম ভেঙে যাবেই। এই নশ্বর দেহের মধ্যে যে একটা ঘড়ি রয়েছে তার টিক টিক আওয়াজ শুনেই সে ঊঠে পড়ে। অত রাতে সে আর কোথাও যায়না। আনমনে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। তারা গোনে। কোন গভীর চিন্তায় যে ডুবে যায়! ঘুম ভেঙে গেলে আর শুয়ে থাকতে পারেনা সে। মনের বিকারে আরো কত কিছু দেখতে পায় সে। ওই যে কে যেন গাছের পাশ দিয়ে চলে গেল! হ্যাঁ ওই তো তার ফীবি! ব্যস এবার বাসন কোসন নিয়ে পাততাড়ি গুটিয়ে হাতের লাঠিটা ঠুক ঠুক করে আবার তার শুরু হয় যাত্রা…নতুন করে খোঁজ। কিন্ত সেই ছায়ামূর্তি যেন লুকোচুরি খেলে তার সঙ্গে। চোখের নিমেষেই উধাও। তার সঙ্গে যে গিয়ে দুটো কথা বলবে…বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়ি নিয়ে যাবে তার কোনো সময়ই পায় না। সেই ছায়াশরীরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। মাঝপথেই রাস্তা হারায়। চোখে জল ভরে আসে…হাহুতাশ করে মানুষটা। তার এই খোঁজ কি আর শেষ হবে না! আর কত পরীক্ষা দিতে হবে তাকে!
দিন যায়্…মাস যায়…দেখতে দেখতে কেটে যে সাত বছর। তার চলা থামে না। এমনই এক বসন্তের দিনে তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলতার স্ত্রী । আর এমনই এক ভরা বসন্তের দিনে বোঁচকা বুঁচকি নিয়ে সে চলে রেড ক্লিফের পাশের মাঠে। তার হাতের লাঠিটাই দৈববলে এই রাস্তায় টেনে এনেছে তাকে। মাইলের পর মাইল হেঁটে এসেছে সে। রাত দশটা বেজে গেছে। ক্লান্তিতে শরীর নুয়ে পড়ে। এত দিন ধরে ভালো করে না খেয়ে এত দূর হেঁটে হেঁটে হাড্ডিসার চেহারা তার। হাড়ের ওপর যেন শুধু একটা চামড়ার পরত। দেহের শক্তি নয় তাদের অদ্ভুত মনের জোরই হয়ত তাকে একদিন টিকিয়ে রেখেছে। আজও ভালো করে খাবার জোটেনি। এই অন্ধকারে সে এবার একটু জিরোবে। পারলে একটু ঘুমিয়েও নেবে।
কিন্তু কেন জানি সে ঘুমোতেও পারেনা। তার চারপাশে কে যেন ঘুরে বেড়াছে। এ নিশ্চয়ইফীবি। কিছুদিন আগেই নিজের মনকে বুঝিয়েছে সে। এত বছর ধরে ফীবিকে পাওয়া যায়নি ঠিকই। কিন্তু এবার ফীবি তার কাছে ধরা দেবেই। আর সে লুকিয়ে থাকতে পারবে না। এবার সে নিশ্চয়ই তার দেখা পাবে। তার সঙ্গে কথা বলবে। এই ভাবতে ভাবতেই হাঁটুর ওপর মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ে সে। মাঝরাতে আবার থালার মতো চাঁদ ওঠে। রাত দুটোতে সে যখন জেগে ওঠে তখন পুব দিকের গাছগুলো রুপোলি আলোয় মোড়া। চোখ খুলে রুপোলি আলোয় তার চোখ ধাঁধিয়ে যায়। চাঁদের আলোয় স্নান করা গাছগুলোকে মনে হয় এক একটা ছায়া শরীর। আবার সেই পুরোনো চিন্তাই মাথায় ফিরে আসে। তার ফীবি এই তো কাছাকাছিই রয়েছে। মনে অনেক আশা নিয়ে চোখ খুলে তাকায় সে। ওই দূরের ছায়ায় কী যেন একটা নড়ে উঠল মনে হয়। ধোঁয়ার মতো কিছু একটা এ গাছ ও গাছের মধ্যে কুণ্ডলী পাকিয়ে যেন ঘুরে বেড়ায়। আর সে তাকিয়ে থাকে নিষ্পলক। গাছের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলোর লুকোচুরির এই মায়াময় পরিবেশে সব কিছু যেন অদ্ভূত ঠেকে। দূরে বাদা জমিতে তির তির করে কেঁপে ওঠা আলেয়া…শত শত জোনাকির ওড়াউড়ি দেখে তার আবার বিভ্রম জাগে। হ্যাঁ হ্যাঁ ওই আলো-শরীর আসলে ফীবির। সত্যিই কি ফীবি তাকে ডাকছে! গোল হয়ে ঘুরতে ঘুরতে আলেয়ার আলো তার পাশ দিয়ে চলে যায়। তার মনে হয় সে ফীবির চোখ দুটো দেখেছে। না না কালো কোট ছাই রঙা শাল পরা যে ফীবিকে শেষ যখন দেখেছে এই সেই ফীবি নয়। কিশোর বয়সে যে মেয়েটির ডাগর চোখ দেখে সে মজেছিল একেবারে এই চোখ। পেলব সে চোখে কিশোরীর উচ্ছ্বলতা। বুড়ো এবার উঠে দাঁড়ায়। আর দেরি করা যাবে না। এতগুলো বছর আশা-নিরাশার দোলায় তার জীবন কেটেছে…সে শুধু স্বপ্নই দেখেছে। এক্ষুনি সে একটা আলোময় শরীর দেখল। নিজের সাদা চুলে আঙুল চালাতে চালাতে সে শুধু চেয়েই থাকে।
অনেক বছর পরে কিশোরী ফীবির ছবিটা তার সামনে ভেসে ওঠে। তার ওই মিষ্টি হাসি…এক ঢাল বাদামি চুল…পোশাকের ওপর একটা নীল শ্যাস। হ্যাঁ হ্যাঁ এটাই তো সে পিকনিকের দিন পরেছিল। তার চলন বলন, হাঁটা চলায় কী আভিজাত্য ছিল!
আর দেরি করে না সে। গাছের তলা থেকে সোজা হাঁটা শুরু করে। চোখটা কুঁচকে কষ্ট করে আলোটা কোন দিকে যাচ্ছে দেখার চেষ্টা করে। নিজের বাসন কোসন…লাঠি কিছুই নেয় না সে। আলেয়ার পিছনে সে শুধু ছুটেই যায়। বসন্তের আলেয়া এদিক থেকে ওদিকে পালায় । ফীবির মাথায় যেন আলোর মুকুট। ছোট ছোট অ্যাশ আর বীচ আর হিকরির গাছের গুঁড়ির মধ্যে দিয়ে আলোটা যেন তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। তরুনী ফিবি তার টকটক ফর্সা হাত দিয়ে তার হেনরিকে ডাকে। ‘ ও ফীবি! ও ফীবি! তুমি কি আজ সত্যিই এলে? তুমি কি আজ আমার ডাকে সাড়া দিলে!’ আলোর রেখা ধরে পাগলের মতো ছুটতে থাকে বুড়ো মানুষটা, একবার আছাড় খেয়ে পড়ে। কোনো রকমে ঊঠে বার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। আলোটা আবার দূরে সরে যায়। খোঁড়াতে খোঁড়াতে আবার রুদ্ধশ্বাস দৌড়। গাছে তার হাত ঘসে যার। জালের মতো হয়ে থাকা গাছের ডালপালায় তার হাত, মুখ বাবার বার ঠোক্কর খায়। তার টুপি কখন যে মাথা থেকে পড়ে গেছে কে জানে। বুকের ভেতর যেন হাপর চলে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে তার। মাথাটা আর কাজ করছে না। উদ্ভ্রান্তের মতো সে শুধু ছুটে চলে। খাড়াই পাহাড়টার ওপরে উঠে তার চোখ চলে যায় আবার নীচে। নীচে রুপোলি আলোয় ঢাকা বসন্তের ভরা আপেল বাগানে ওই যে সেই আলো… ‘ও ফীবি…ও ফীবি এবার আর আমায় ছেড়ে যেয়োনা’। ওই তো সেই জগত যেখানে শুধুই ভালোবাসা…সেখানে মানুষের বয়স বাড়েনা…সেই চির যৌবনের দুনিয়ায় সেও এবার যাবে। ফেলে আসা দাম্পত্যের দিনগুলোর কথা ভেবে চেঁচিয়ে ওঠে সে ‘ ফীবি আর একটু দাঁড়াও। আমি এক্ষুনি আসছি’। তারপর এক ঝাঁপ।
দিন কয়েক পরে এই এলাকারই এক চাষি গাছের গুঁড়িতে বাঁধা বাসন কোসনগুলো দেখতে পায়। তারপর পাহাড়ের নীচে পাওয়া যায় মানুষটার দেহ…হাত পা গুঁড়িয়ে যাওয়া সেই দেহ। কিন্তু মুখে কী প্রশান্তি ! তার ঠোঁটে হাসির আভাস। এতদিনে সেযেন পরম শান্তি পেয়েছে। পরে তার টুপিটাও পাওয়া যায়। কোনো একটা গাছের ডালে আটকে পড়েছিল। এখাকার সাদাসিদে লোকজনেরা বুঝতে পারে না আজ কতদিন পরে মানুষটা তার হারানো সাথীকে ফিরে পেয়েছে। আজ যে তার শুধুই আনন্দ। যে হারিয়ে গিয়েছিল তাকে বুঝি আজ আবার নতুন করে পেল সে।
‘ যা হারিয়ে যায়’ গল্পটি থিয়োডোর ড্রেইসারের ‘ দ্য লস্ট ফীবি’ গল্পের অনুবাদ।